ছোট্ট সোনামনির প্রাণপ্রিয় মা গেছেন স্কুলে, শিশুসন্তানকে ভর্তি করাবেন বলে। কোনো স্কুলের গেটে অপেক্ষমান অভিভাবকরা কম-বেশি সবাই শিক্ষিত, কেউ হয়তো শিক্ষানুরাগীও। অথচ সেখানে উন্মত্ত কতিপয় অভিভাবকরাই একজন ভর্তিচ্ছু সন্তানের মাকে স্কুলের সামনে দানবের মতো পেটাতে পারে? সর্বশক্তি দিয়ে বুটের আঘাত মারতে পারে? লাঠি দিয়ে, লোহার রড দিয়ে মেরে, থেঁতলে, পিষে, ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত করে ততক্ষণ পেটাতে পারে, যতক্ষণ না তার শেষনিশ্বাস বেরিয়ে যায়? এমনকি নিশ্বাস বের হবার পরও? নিস্তেজ মহিলার শরীরে লোহার ফ্ল্যাট বার দিয়ে আঘাত করা এবং অজ্ঞান শরীরের উপর পিশাচদের নেচে নেচে লাথি মারা!
আসলে ওরা হয়তো শিক্ষিত, কিন্তু সু-শিক্ষিত হয়নি। হয়তো সভ্যধারী, কিন্তু সু-সভ্য নয়, অসভ্য! কারণ, সভ্য পৃথিবীতে একটা সাপকেও মারা যায় না, বাঘকেও না। এমনকি একটি কুকুর, বিড়ালকে মারার কথা সভ্য মানুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। সেখানে একজন মানুষকে মারার কথা কীভাবে ভাবা যায়! একমাত্র ধ্যানে-জ্ঞানে যারা পশুত্ব ধারণ করে রয়েছে, তারাই পারে এরকম কাজ করতে।
ছোট্ট সোনামনি অপেক্ষায় রয়েছে, মা ফিরে আসবে বলে। মা ফেরেন না। বাবা স্কুলে গেছেন ছেলেকে আনতে, তাকে আমরা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছি। একটি গুজব; একটি দেশের, সমাজের, পরিবারের, ব্যক্তির, একটি শিশুর সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকলো!
বাড্ডায় তাসলিমাকে টেনে-হিঁচড়ে স্কুলের হেডমাস্টারের রুম থেকে থেকে বের করে আনা হলো। কেউ একবারও বিবেচনাও করল না, তিনি আদৌ ছেলেধরা ছিলেন কি না? এরপরই শুরু বেদম পিটুনি। যে পিটুনির কোনো গ্র্যামার নেই, যেমন খুশি তেমন মারো। বাড্ডায় গুজবে, অন্যায়ভাবে নিহত হওয়া ভদ্রমহিলার ঘটনাটি পরে, ভিডিওর মাধ্যমে বর্বর ও হিংস্রতার দৃশ্য দেখে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলার কথা বলেছেন। যদিও তিনি তাদের আপনজন কেউ নন। তবুও তার জন্য বারবার চোখ ভিজিয়েছেন। আহারে… এই ‘মা’ টি কত কষ্ট পেয়েই না মারা গেছেন! হে মা আমাদের ক্ষমা করো!
যারা মেরেছে তারা কেউ মূর্খ নন! সবারই হয়তো পরিবার আছে। তারাও ঘরে ফিরে নিজের সন্তানকে আদর করেন। সেদিনও নিশ্চয়ই মহিলাকে যারা মেরেছেন তাদের কেউ কেউ বাসায় গিয়ে হাসিমুখে পরিবারের সাথে গল্প করেছেন, সন্তানরাও পিতা-মাতাকে পেয়ে আনন্দিত হয়েছে। তাসলিমা বেগমকে হত্যাকারীদের কাছে জিজ্ঞাসা, পেটানোর মুহূর্তে কি নিজেদের মা-বোন বা সন্তানের কথা মনে পড়েনি?
‘কান নিয়ে গেল চিলে’, শুনে কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে দৌড়! গুজব ছড়ানো হলো, আর মাথা মোটা জানোয়াররুপি মানুষগুলো চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধিকে বিকিয়ে খুনের আশ্রয় নিলো! এক বিন্দুও বুকটা কাপল না! কাকে মারলি, কেন মারলি, এক বিন্দুও ভাবলিনা! রাজধানী শহরে একজন ভদ্রমহিলাকে কতিপয় হায়েনার দল পিটিয়ে মারলো, কেউ বাঁচাতে আসলো না। কি অসভ্য সমাজে বাস করছি আমরা!
এছাড়াও ‘শিশু ধর্ষণ’ কথাটি ভাবতেই মন বেদনায়, লজ্জায়, কষ্টে মুচড়ে যায়। অথচ শিশু ধর্ষণ ও হত্যা যেন নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ কোন দুঃসময় পার করছি আমরা? পত্রিকার পাতায় সব ঘটনা তো খবর হয়ে আসে না। কত ঘটনাই তো গভীর ক্ষত আর নীরব চোখের পানিতে চাপা পড়ে যায়, পারিবারিক আর সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ হয়েছে ৬৩০টি, ধর্ষণজনিত হত্যা ২১টি। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে ৩শ’র কিছু বেশি। কতিপয় অ-মানুষ জলে-স্থলে, আকাশে-পাতালে, অফিসে-আদালতে, স্কুলে-কলেজে, যেখানে যা পাচ্ছে তা লুটেপুটে, চেটেপুটে খাচ্ছে, রাক্ষসের মত গোগ্রাসে গিলছে। এদের কে থামাবে? কে পুলিশকে জনাবেন? পুলিশকে বলে লাভ নেই, এমন মানসিকতা থেকেই কি গুজব ও গণপিটুনির ঘটনা? পুলিশ প্রশাসনের ওপর জনতার ভরসা নেই বলেই তারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়। গণপিটুনি দিয়ে চোর, পকেটমার বা ডাকাতকে মারা এই দেশে নতুন নয়।
বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যায় না, শাস্তি দেয়া যায় না। বিচারের রায় না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধীও বলা যায় না। কেউ যদি অপরাধী হয়, শাস্তি দেবে আদালত। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে গণপিটুনির শিকার সভ্য জগতে হতে পারে না। কেউ যদি সত্যি সত্যি ‘ছেলেধরা’ হয়েও থাকে, তাহলেও তাকে পেটানো যায় না। আইনত তো নয়ই, নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো বিবেচনায়ও নয়। কানে গুজব শুনেই হাতে আইন তুলে জল্লাদ রূপ ধারণ করা যায় কী? গুজব একশ্রেণির মানুষ শুধু ভোগই নয় উপভোগও করে থাকে। হোক সে ভিখারি, পাগল, প্রতিবন্ধী, ভারসম্যহীন, অপরিচিত বা মানসিক অবসাদগ্রস্থ। সেতো মানুষ! মানুষের জীবন জীবনই। কিন্তু জনতা যখন একজন অপরিচিত মানুষকে রাস্তাঘাটে, দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করে, তখন তা আদিম বর্বরতাকেও হার মানায়।
বিচারহীনতাই মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। বিচারহীনতা এ সমাজে রয়েছে, এ তো অনেক পুরোনো কথা। কিন্তু এর আগে মানুষ এতটা জেরবার তো হয়নি। তাহলে এখন কেন হচ্ছে? এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের আওতায় বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র যখন কোনো সন্ত্রাসী বা নরপিশাচদের বিচার করে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে নিস্ক্রিয় অবস্থায় থাকে তখন এর দায় রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের উপরও বর্তায়। আইন না মানার উদ্দেশ্য যত ভালোই হোক না কেন, পরিণতি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সব সময় করুণ হয়েছে। জনরোষের পূর্বাবস্থা মূলত হতাশা! দীর্ঘদিন নির্যাতিত হওয়া এবং কোনোভাবেই এ থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া, বিচার না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণেই এ জনরোষ জন্ম নিতে পারে।
দেশ এখন ছেলে ধরা নামক এক গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত বলা যায়। তাসলিমা বেগমকে যখন গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ঢুকে পড়াটাই স্বাভাবিক। একদিকে গণপিটুনির আতঙ্ক, অন্যদিকে ‘ছেলেধরা’ নামক গুজবের আতঙ্ক, দুটিই এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছে, যার সুরাহা অবশ্যই সমাজের সর্বস্তরের সচেতনতা ও কঠোর আইন বা নজরদারি দ্বারাই সম্ভব।
রাষ্ট্রকে মানুষের কথা শুনতে হয়, তার অভিযোগ আমলে নিয়ে সেই মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়। একটি ন্যায্য সমাজ সৃষ্টি করে, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে পারে। কিন্তু যখনই এ সবের কোনো একটিতে ঘাটতি দেখা যায়, তখনই মানুষের মধ্যে তৈরি হয় অনিরাপত্তাবোধের। অনিরাপত্তাবোধ যত বাড়ে, মানুষের মধ্যে তত অস্বস্তি বাড়ে, হতাশা কাজ করে। এই অনিরাপত্তাবোধ থেকে উদ্ভূত হতাশাই একসময় আতঙ্কে রূপ নেয়।
সমাজে একদল লোক যখন আইন অমান্য করবে, পরবর্তীতে তার যে পরিণতি হওয়ার কথা ছিল, সেই পরিণতি না হতে দেখে, আস্তে আস্তে অনেকেই ভাবতে শুরু করবে, ওর যখন কিছুই হয়নি, আমারও হবে না। আর তাই ছোট্ট শিশু আয়েশাকে হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় বসে কাঁদতে হয় মা রাজিয়া সুলতানাকে। মামলাও হয়েছে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে। আসামিপক্ষ প্রভাবশালী, তাই বিচার পাবেন না, এমন আশঙ্কায় হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে রাস্তায় বসেছিলেন আয়েশার মা রাজিয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন অজুহাতে এবং হরেক রকমের গল্প ফেঁদে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চাউরে মানুষ মারছে। এখন যেভাবে মরছে, সেটাকে আমরা বলছি ‘গণপিটুনি’; দুইটাই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নয়তো?
রাষ্ট্র নিজেই বিচারের ধীরগতির ওপরে আস্থা রাখতে পারছে কী? তাহলে ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টার কেনো? আমাদের ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধেও সরব হতে হবে। মানুষ দেখছে তনু হত্যার বিচার, বিশ্বজিৎ ও সাগর-রুনি হত্যার ৭২ ঘণ্টা আর শেষ হয় না। বিচারে ধীরগতি বিচারহীনতারই নামান্তর। মানুষ এখন হিংস্র হয়ে উঠছে! আইনের প্রতি কারো না আছে শ্রদ্ধা, না ভরসা, না ভয়! এছাড়া পুলিশ বাহিনীর অপেশাদারিত্ব ও দুর্নীতি এসবের জন্য দায়ী। একজন ধর্ষক ধরা পরার পর সাথে সাথেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়, অথবা হাতে নাতে ধরা পরে, কিন্তু তাকে ধর্ষক বলতে হলে কেন আদালতের রায়ের জন্য বছরে পর বছর অপেক্ষা করতে হবে?
প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে মানুষ যেভাবে নিগৃহীত আর অবহেলিত, অন্যদিকে জবাবদিহিতার তো কোন বাধ্যবাদকতাই নেই। এসব মানুষের মনে একটা ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পালিত ‘নয়ন বন্ডরা’ সমাজে একটা ত্রাসের অবস্থা তৈরি করে রেখেছে। দুষিকে দোষ দেয়ার উপায় নেই, তাইতো হুজুগে-গুজবে যদি কারো উপর এইসব ক্ষোভ একটু মেটানো যায়…। বাড্ডার তাসমিলা হত্যার দায় আমার, রাষ্ট্রের, প্রত্যেকেরই। পরিবর্তন জরুরি আমাদের আদর্শের, নৈতিকতার ও মানসিকতার।